স্বদেশ ডেস্ক:
রাজধানীর ধানমন্ডির কামরুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নুর তাবাসসুম সুলতানা। ২০১৬ সালে ওই স্কুল থেকে জেএসসি ও ২০১৯ সালে এসএসসি পরীক্ষায় পাস করে একটি কলেজেও ভর্তি হন। গত ২১ আগস্ট তার মোবাইলে এইচএসসির ফরম ফিলাপের টাকা জমা দেওয়ার তাগাদার একটি মেসেজ আসে। কিন্তু সেটি পড়ে রীতিমতো আক্কেলগুড়–ম বনে যান তাবাসসুম। অনলাইন ঘেঁটে দেখেন- নিজের একাডেমিক ব্যক্তিগত তথ্য পুরো ওলট-পালট। রোল ও রেজিস্ট্রেশন নম্বর ছাড়া তার নিজের নাম, বাবা-মায়ের নাম ও জন্মতারিখ সবই পরিবর্তন হয়ে গেছে। কিন্তু কেন? কীভাবে, কে তার এসব তথ্য পরিবর্তন করল সেটি তাবাসসুম ও তার পরিবার সুরাহা করতে না পেরে সংশ্লিষ্ট স্কুল-কলেজ কর্তৃপক্ষের দারস্থ হন। তারাও এ ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি। পরে তারা শিক্ষা বোর্ডে গিয়ে দেখেন- তাবাসসুমের এসএসসির পাশাপাশি জেএসসির সার্টিফিকেটেরও তথ্য পরিবর্তন হয়ে গেছে। উপায়ান্তর না পেয়ে পুরো বিষয়টি উপস্থাপন করে ধানমন্ডি মডেল থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা করা হয়।
তাবাসসুমের পরিবারের করা মামলাটির তদন্ত করতে গিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য পায় ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ। তাদের তদন্তে উঠে আসে- একটি প্রতারক চক্র ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অসাধু কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে টাকার বিনিময়ে দীর্ঘদিন ধরে জাল সনদ তৈরি করে আসছে। ওয়েবসাইটে তথ্য বদলে দিয়ে ‘এসএসসি পাস’ করিয়ে দিচ্ছে। সব কিছুই যেন তাদের কাছে পান্তাভাত। তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকার বিনিময়ে শিক্ষার্থীদের আসল সনদের তথ্য মুছে নতুন তথ্য জুড়ে দিয়ে চক্রের সদস্যরা তৈরি করছে এসব জাল সনদ। শুধু তাই নয়, আসল শিক্ষার্থীদের অজান্তেই রোল ও রেজিস্ট্রেশন নম্বর ছাড়া নিজের নাম, বাবা-মায়ের নাম- এমনকি জন্মতারিখের তথ্যও পরিবর্তন করে দিচ্ছে। এতে করে আসল শিক্ষার্থীর সনদই হয়ে পড়ছে মূল্যহীন। এভাবে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অসাধু কয়েকজনের যোগসাজশে ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এমন অপকর্ম করে আসছিল চক্রটি। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ভয়ঙ্কর এই প্রতারণায় জড়িত সাতজনকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দারা। গত শুক্রবার রাজধানীর মোহাম্মদপুর, রমনা ও চকবাজার এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে জব্দ করা হয় বিপুল পরিমাণ অ্যাডমিট কার্ড, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের নাম ও অনলাইন রেজাল্ট শিটের কপি।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- নূর রিমতি, জামাল হোসেন, একেএম মোস্তফা কামাল, মারুফ, ফারুক আহম্মেদ স্বপন, মাহবুব আলম ও আবেদ আলী। এদের মধ্যে মো. মারুফ ঢাকা বোর্ডের কর্মচারী। আর মোস্তফা কামাল চক্রের মূল হোতা। যার জন্য তাবাসসুমের সনদের তথ্য মুছে ফেলা হয়, সেই নূর রিমতি হচ্ছেন জাল সনদের আবেদনকারী। আর জামাল হোসেন তার মামা। এই মামার মাধ্যমেই চক্রের মূল হোতা মোস্তফা কামালের সন্ধান পান গোয়েন্দারা। গ্রেপ্তার ফারুক আহম্মেদ স্বপন, মাহির আলমা ও আবেদ আলী হলেন চক্রের সহযোগী বাবা দালাল। জাল সার্টিফিকেট তৈরি করতে আগ্রহী এমন ব্যক্তির সঙ্গে তারা চুক্তি করেন।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) একেএম হাফিজ আক্তার গতকাল রবিবার দুপুরে বলেন, ‘গ্রেপ্তার নূর রিমতি বেশিদূর লেখাপড়া করেননি। তার ইতালি যাওয়ার জন্য এইচএসসি পাসের সনদ প্রয়োজন হয়। তাই এ সনদের জন্য তিনি একটি কলেজে ভর্তি হতে চান। তার জন্য এসএসসির সনদ দরকার হলে মামা জামাল হোসেনের মাধ্যমে মোস্তফা কামালের সঙ্গে তিন লাখ টাকায় চুক্তি করেন। চুক্তি অনুযায়ী কামাল শিক্ষা বোর্ডের দালাল মারুফের সঙ্গে সমন্বয় করে নূর রিমতির নামের কাছাকাছি মিল করে নূর তাবাসসুমের সার্টিফিকেট সংক্রান্ত জেএসসি ও এসএসসি পাসের সব তথ্য সংগ্রহ করেন। এর পর তারা প্রথমে শিক্ষার্থীর বাবার নাম, মায়ের নাম সংশোধনের জন্য শিক্ষা বোর্ডের নির্ধারিত ফরম্যাটে আবেদন করেন। আবেদনের সঙ্গে যেসব কাগজপত্র দেওয়া হয় সেগুলো ছিল জাল। তার জন্য শিক্ষা বোর্ডের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের টাকার বিনিময়ে বোর্ডের ওয়েবসাইটের রেজাল্ট আর্কাইভে নির্ধারিত ফরম্যাটে সংরক্ষিত প্রকৃত শিক্ষার্থী নূর তাবাসসুমের তথ্য পরিবর্তন করে নূর রিমতির তথ্য আপলোডের মাধ্যমে জাল সনদ তৈরি করেন। একই প্রক্রিয়ায় জন্মতারিখ পরিবর্তন করা হয়। পরিবর্তিত এসব তথ্য শিক্ষা বোর্ডের ওয়েবসাইটেও দেখায়।’
হাফিজ আক্তার আরও বলেন, ‘প্রতারক চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডসহ অন্যান্য শিক্ষা বোর্ডের বিভিন্ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের নাম, বাবার নাম, মায়ের নাম, জন্মতারিখসহ অন্যান্য তথ্য বদলে অকৃতকার্যদের সনদ দিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছিল মোটা অঙ্কের টাকা। চক্রের সঙ্গে জড়িত শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।’ ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘যারা বিভিন্ন পরীক্ষায় পাস করেছেন, তারা শিক্ষা বোর্ডের আর্কাইভে ঢুকে ফল যাচাই করুন। কোনো পরিবর্তন দেখলে বোর্ড কর্তৃপক্ষকে বা পুলিশকে জানান। নূর তাবাসসুমের মতো কেউ ভুক্তভোগী হয়ে থাকলে, তাদের ডিবির সঙ্গে যোগাযোগের অনুরোধ জানাই।’
ভুক্তভোগী নূর তাবাসসুম সুলতানার মা রোকেয়া সুলতানা বলেন, ‘মেয়ের সনদে তার নাম, বাবার নাম ও আমার নাম পরিবর্তন হয়েছে সেটি আমরা জানতাম না। এইচএসির ফরম ফিলাপের টাকা জমা দেওয়ার একটি মেসেজ আসার পরই তা জানতে পেরেছি। এর পর তার স্কুলে যোগাযোগ করলে তারা বোর্ডে যাওয়ার পরামর্শ দেন। বোর্ডে গিয়ে জানতে পারি মেয়ের জেএসসি ও এসএসসির রোল ও রেজিস্ট্রেশন নম্বর ছাড়া ব্যক্তিগত সব তথ্যই পরিবর্তিত হয়েছে। পরে আমরা ধানমন্ডি থানায় মামলা করি।’
ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ শরীফুল ইসলাম বলেন, গ্রেপ্তার মারুফ ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে খ-কালীন কাজ করেন। তার মাধ্যমেই সার্ভার থেকে নাম ও রোল পরিবর্তন করা হয়। এই চক্র আরও কয়েকজনের জন্য এমন জাল সনদ তৈরি করে দেওয়ার সঙ্গে জড়িত। ঘটনায় বোর্ডের আর কোনো কর্মকর্তা ও কর্মচারী জড়িত কি-না তদন্ত চলছে।
ডিবি সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার আশরাফউল্লাহ বলেন, প্রায় ১০ বছর ধরে চক্রটি বোর্ডের কিছু অসাধু কর্মচারী-কর্মকর্তার টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে আসল সনদ নকল করছিল। শুধু জাল সনদ নয়,তারা রেজাল্ট পরিবর্তন, জিপিএ বাড়িয়ে দেওয়াসহ আরও নানা অবৈধ কর্মকা- করত। জাল সনদ তৈরি করতে তারা যে আবেদন করত, সেখানে প্রয়োজনীয় সকল কাগজপত্র জাল তৈরি করে দিত। আমরা জাল সার্টিফিকেটের আবেদনকারী নূর রিমতি ও তার মামাকেও গ্রেপ্তার করেছি। নূর রিমতি জাল সনদ তৈরি করে ঢাকার একটি নামকরা কলেজেও ভর্তি হয়েছিল। শিক্ষা বোর্ডের ওয়েবসাইটে রেজাল্ট চেকিং অপশনে রেজিস্ট্রেশন নম্বর ছাড়া শুধু রোল নম্বর দিয়ে রেজাল্ট চেক করা যাচ্ছে। রেজিস্ট্রেশন নম্বর সেখানে প্রয়োজনীয় না হওয়াতে রোল নম্বরের ডিজিট পরিবর্তন করে ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষার্থীর তথ্য মিলছে। এতে করে তারা যার নামে জাল সনদ তৈরি করবে তার সঙ্গে মিল করে অন্য শিক্ষার্থীর তথ্য পেয়ে যাচ্ছে। শিক্ষা বোর্ডের এই বিষয়টির ওপর নজর দেয়া দরকার। রেজাল্ট চেকের সময় রেজিস্ট্রেশন নম্বরটা বাধ্যতামূলক করা দরকার।
জানা গেছে, জাল সার্টিফিকেট তৈরি করতে ইচ্ছুক এমন ব্যক্তিরা প্রথমে চক্রের মূল হোতা মোস্তফা কামাল বা তার সহযোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। কারণ চক্রের সদস্যরা দেশজুড়ে ছড়িয়ে-ছটিয়ে আছে। পরে তারা জাল সার্টিফিকেট তৈরির জন্য কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ওই ব্যক্তির কাছ থেকে সংগ্রহ করে কামালকে দেয়। এর পর কামাল সার্টিফিকেট তৈরি করতে ইচ্ছুক ব্যক্তির নাম মিলানোর জন্য শিক্ষা বোর্ডের ওয়েবসাইটে রেজাল্ট দেখার অপশনে গিয়ে সার্চ করে। এভাবে ওই নামের কাছাকাছি একটি নাম খুঁজে বের করে। পরে ওই নামের ব্যক্তির নিজের নাম, পিতামাতার নাম পরিবর্তনের আবেদন শিক্ষা বোর্ডের অনলাইনে জমা দেওয়া হয়। আবেদনের সঙ্গে সাপোর্টিং ডকুমেন্ট হিসাবে প্রার্থীর যেসব কাগজপত্র জমা দেওয়া হয়, সেগুলোও জাল তৈরি করে প্রতারকরা। এমনকি আবেদনের সঙ্গে প্রার্থীর যে ছবি দেওয়া হয় সেটিও অন্য মানুষের। আবেদনের পর কামাল শিক্ষা বোর্ডে থাকা তার এজেন্টের মাধ্যমে নাম পরিবর্তনের বোর্ডে আবেদনটি অনুমোদনের জন্য বোর্ড কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে। কামাল ও বোর্ডের এজেন্ট নাম পরিবর্তনের জন্য বোর্ডের সচিবকে ম্যানেজ করে। তারপর সচিবের নির্দেশে বোর্ডের উপসচিবকে ম্যানেজ করে আবেদনের আইডি সংগ্রহ করে। সচিব ও উপসচিবকে ম্যানেজ করার পর আবেদনটি বোর্ডে অনুমোদন দেওয়া হয়। বোর্ড অনুমোদন দেওয়ার পর জাল সার্টিফিকেট প্রার্থীর তথ্য বোর্ডের ওয়েবসাইটে প্রদর্শন হয়। এর পর আবেদনকারী তার চাহিদা অনুযায়ী নামে সার্টিফিকেট ও এডমিট কার্ড সংগ্রহ করতে পারে। এভাবে তারা দীর্ঘদিন ধরে অসংখ্য সনদ জালিয়াতি করে।
আরও জানা গেছে, কোনো শিক্ষার্থীর নিজের নাম, বাবা-মায়ের নাম পরিবর্তন করতে হলে তাকে বোর্ডের নির্ধারিত ফরমে আবেদন করতে হয়। নাম পরিবর্তনের জন্য একটি আবেদন এবং জন্মতারিখ পরিবর্তনের জন্য আরেকটি আবেদন করতে হয়। তার সঙ্গে বেশ কিছু বৈধ কাগজপত্রও জমা দিতে হয়। আবেদন করার পর শিক্ষা বোর্ডের সংশোধন কমিটি ও বোর্ড কমিটির যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে প্রার্থীর চাহিদা অনুযায়ী তথ্য পরিবর্তনের অনুমোদন দেয়। কিন্তু প্রতারকরা ভুক্তভোগী তাবাসসুম সুলতানার নাম ও জন্মতারিখ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে যেসব কাগজপত্র জমা দিয়েছে, সেগুলো জাল। এসব কাগজপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের ঊর্ধ্বতন দুই কর্মকর্তা ২০২০ সালের ২৯ অক্টোবর নূর তাবাসসুম সুলতানার আবেদনের প্রেক্ষিতে সংশোধনের অনুমোদনের চিঠিতে স্বাক্ষর করেন। অভিযোগ রয়েছে, প্রতারক চক্র এ কর্মকর্তাদের অধীনস্তদের দিয়ে তাদের টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ করে স্বাক্ষর করিয়েছেন। ডিবির হাতে গ্রেপ্তার হওয়া চক্রের সদস্যরাও প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, টাকার বিনিময়ে ওই কর্মকর্তাদের দিয়ে স্বাক্ষর করানো হয়েছে।